গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী অধ্যাপক মোহাম্মদ হাশেম

গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী অধ্যাপক মোহাম্মদ হাশেম নোয়াখালীর মাটি ও মানুষের অন্তরের মুকুটহীন সম্রাট মোহাম্মদ হাশেম। তাঁর গানের কথা ও সুরে ঝংকৃত হয় গণমানুষের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত কথামালা।

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাশেম একজন বিরল প্রতিভার কালজয়ী গীতিকবি। তাঁর গান শুধু নোয়াখালীর নয়, গোটা দেশের তথা বৈশ্বিক সম্পদ। মোহাম্মদ হাশেমের গান শুধু গান নয়, তাতে একদিকে যেমন রয়েছে নোয়াখালীর আদি এবং অকৃত্রিম ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস; তেমনি রয়েছে প্রান্তিক থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের নানান গল্প। গণমানুষের ভাবনা, প্রবৃত্তি, আচার, উপলব্ধি, সীমাবদ্ধতা, প্রেম, বিরহ, মোহ, হতাশা অবিরত শব্দে তাঁর গানে উঠে এসেছে। একজন চিত্রকর যেমন ছবি আঁকেন, একজন গল্পকার যেমন গল্প লিখেন অথবা নাট্যকার লিখেন নাটক, অধ্যাপক মোহাম্মদ হাশেমের গানেও একই ধরণের চিত্রকল্প দেখা যায়। তাঁর গানে কিছু চরিত্র দেখা যায়, সেই চরিত্রগুলোয় থাকে মানুষের জীবন যাপনের নানা দিক, পেশা, ভাবনা, তাদের যাপিত জীবনের আঘ্রাণ। একই সাথে মেলে সৃষ্টিতত্ত্ব। মোহাম্মদ হাশেম তাঁর গানে যেভাবে বহুমাত্রিক ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন, তা সমসাময়িক বিশ্বসঙ্গীত ভান্ডারে খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। এজন্য তাঁর গানকে কখনোই শুধু আঞ্চলিক গান বলা যায় না, মুলত নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা যুগশ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা। তাঁর গান একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল ও সময়কে ছাড়িয়ে বহুমাত্রিকতায় পরিব্যপ্ত। তিনি শুধু গীতিকার নন, গীতিকবি। যদি তাঁর গান লেখার ভাষা নোয়াখালীর আঞ্চলিক না হয়ে প্রমিত শব্দমালা বেছে নিতেন, তাহলে এতোদিনে বিশ্ব সাহিত্যে তাঁকে নিয়ে হয়তো কাড়াকাড়ি সৃষ্টি হতো।

বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ও পরে শিক্ষক বলেই হয়তো তাঁর গানে উপমা, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা, অন্তমিলের নান্দনিক প্রকাশ মেলে। শব্দচয়ন, শব্দ বিন্যাসে রয়েছে সহজাত মুন্সীয়ানা। তাঁর গানে যেভাবে চিত্রকল্প, রসবোধ, চরিত্র সৃষ্টি, সংলাপ, ভাব বৈচিত্রের প্রকাশ ঘটেছে, তা তা বিশ্ব সঙ্গীত ভান্ডারে বিরল। অধ্যাপক মোহাম্মদ হাশেমের গানের চরিত্রগুলোর বেশীরভাই গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। আর এই মানুষগুলোকে হাশেম নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছেন, অনুধাবন করেছেন তাদের মনোজাগতিক ভাবনা, স্বপ্ন, ভ্রান্তি ও বৈকল্য; যা দেখে বিস্মিত হতে হয়। মোহাম্মদ হাশেমের পর্যবেক্ষণ শক্তি অসাধারণ। কোনো একদিন আসবে, যেদিন বর্হিবিশ্ব থেকেও মানুষ এদেশে আসবে হাশেমের সৃষ্টির নিয়ে গবেষণা করতে।

গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী মোহাম্মদ হাশেম ৪০ বছর নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান নিয়ে গবেষণা করছেন। লিখেছেন অন্তত দুই হাজার গান। নিজেই গেয়েছেন বেতার-টেলিভিশনে। নোয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষাকে প্রথম সংগীতে রূপান্তর করে একে দিয়েছেন বিশ্ব পরিচিতি। শুধু নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানই নয়, তিনি পাঁচ শতাধিক পল্লীগীতিও লিখেছেন। লোকমুখে তিনি নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানের সম্রাট, জনক, কিংবদন্তী।

মোহাম্মদ হাশেম ১৯৪৭ সালের ১০ জানুয়ারি নোয়াখালী সদরের চরমটুয়া ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলে মাধ্যমিক পাশ করেন। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সনদপ্রাপ্ত হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তার সঙ্গীত প্রতিভার ঊন্মেষ ঘটে। সংগীতেও তার উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে। ঢাকা মিউজিক কলেজে সংগীতে ডিগ্রী নেয়ার পর তিনি সেখানেই বাংলা বিভাগ ও সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে মোহাম্মদ হাশেম নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় গান লিখতে শুরু করেন। এর আগে নোয়াখালী অঞ্চলের কোনো গান ছিল না। তার হাত ধরেই এ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা, আনন্দ-বেদনা, মেঘনা পাড়ের মানুষের সংগ্রামী জীবনাচার সংগীতে রূপ নেয়। তার অধিকাংশ গান সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। নোয়াখালীর প্রধান সংগীত খ্যাত ‘আঙ্গো বাড়ি নোয়াখালী রয়াল ডিস্ট্রিক ভাই/ হেনী মাইজদী চৌমুহনীর নাম কে হুনে নাই’-গানটি শুধু তাঁকে নয়, নোয়াখালীর ভাষা ও সঙ্গীতকে এনে দিয়েছিলো জগতজোড়া খ্যাতি। এ গান আজও মানুষের মুখে মুখে। তার জনপ্রিয় অন্যান্য গানের মধ্যে রয়েছে, ‘আল্লায় দিসে বাইল্লার বাসা নোয়াখাইল্লা মাডি’, ‘নোয়াখালীর দক্ষিণে দি উইটসে নোয়া চর’, ‘রিকশাঅলা কুসকাই চালা ইস্টিশন যাইয়াম’, আহারে ও কুলসুম কতুন আইলো ডুবাইআলা কইল্লো এ জুলুম’। সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৭০ সালে রেডিও পাকিস্তানের ‘অনুষ্ঠান সংগঠক’ হিসেবে তার পেশাজীবন শুরু। পর্যায়ক্রমে ঢাকা সংগীত কলেজ, কবিরহাট সরকারি কলেজ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজসহ দেশের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতার পর তিনি ২০০৫ সালেে নোয়াখালী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে অবসর নেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের বিশেষ শ্রেনীভূক্ত গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। মোহাম্মদ হাশেমের সঙ্গীতের প্রথম গুরু বাংলা লোক সঙ্গীতের দিকপাল আব্দুল আলীম। তিনি ওস্তাদ বারীন মজুমদারের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, ওস্তাদ আবিদ হোসেন খানের কাছে তত্বীয় সঙ্গীত, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে তবলায় দীক্ষা নেন। ১৯৭৪ সালের দিকে তিনি নিজ বাসভূম নোয়াখালীতে গিয়ে শুরু করেন শিক্ষকতা ও সঙ্গীত সাধনা।

২০০৫ সলে একুশে বইমেলায় বের হয় এই সাধক পুরুষের গানের প্রথম সংকলন ‘নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান’। ২০১৫ সালে মোহাম্মদ হাশেমের রচিত বাছাই করা আড়াইশ’ গান নিয়ে উৎস প্রকাশন বের করে ‘নির্বাচিত নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান’। মোহাম্মদ হাশেম ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান এখন যেন সমার্থক। মোহাম্মদ হাশেম ২০২০ সালের ২৩ মার্চ ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র, তিন কন্যাসহ আত্মীয় স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী, ভক্ত ও শ্রোতা রেখে গেছেন।

Documentary on Hashem. নোয়াখালীর সুর সম্রাট হাশেম || পরিচালনা: সানজিদা সুলতানা